দুর্নীতি আর ভেজালের বেড়াজালে আবদ্ধ এই জাতি
1,854 Views
‘খাঁটি জিনিষ’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
–কবি সুকান্ত
‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
–কবি সুকান্ত
যে মাংসে ভেজাল করছে সে ভেজাল তেল খাচ্ছে। তাই খাদ্য ভেজাল মেশাচ্ছে ব্যবসায়ীরা আবার সেই ভেজাল মেশানো খাবার আমজনতার সাথে ব্যবসায়ীরাও খাচ্ছে। বাঙালিই মারছে বাঙালিকে- সেটা মনে হয় নীরদ সি চৌধুরী বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাইতো তিনি বলতেন “আত্মঘাতী বাঙালি”।
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে ৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার।
কথিত আছে ওয়াটার লু এর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর নেপোলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপ এ বন্দি রাখা হয়। ধারণা করা হয় প্রতিদিন খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে আর্সেনিক মিশিয়ে নেপোলিয়নকে খেতে দেওয়া হত। এভাবে স্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে নেপোলিয়নকে হত্যা করা হয়। নেপোলিয়নকে তার অজান্তেই স্লো পয়জনিং এর মাধ্যমে হত্যা করা হয়। কিন্তু, আমরা তো নিজেরাই নিজেদেরকে বিভিন্ন বিষাক্ত খাবার গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্লো পয়জনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমরা জানি কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।
আজকের বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বাজার থেকে কেনা কোনো খাদ্যই যেন আর বিশুদ্ধ নেই। কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হয় খাবারের মশলায়। তেল, আটা, চিনি, কেক, বিস্কুট কিছুই আজ ভেজালমুক্ত নয়। বাজারের ৮৫ শতাংশ মাছে ফরমালিন মিশিয়ে পচন রোধ করা হয়। শাকসবজিতে বিষাক্ত স্প্রে, সব ধরনের ফলমূল দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে সর্বত্র কার্বাইড, ইথোফেন, আর পচন রোধে ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। নকল ও ভেজাল ওষুধে ছেয়ে গেছে বাজার।
কী খাচ্ছি আমরা? কী খাওয়াচ্ছি আমরা? আপনি আদর করে আমার পাতে কী তুলে দিচ্ছেন? আমিই বা নিখাদ ভালোবাসায় অনেক যত্ন করে আপনার পাতে কী উঠিয়ে দিচ্ছি? বাঙালি রসনার নানা জটিল রসায়নের কারিগরি উদ্ধার করা গেলেও বাঙালির পাতে ভেজাল খাবার কী উপায়ে এল, আর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর নানা ফন্দিই বা ঠিক কোথা থেকো রপ্ত হলো, তা দুর্বোধ্য।
খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ক্রেতার সাথে প্রতারণা করা। প্রতারণা ইসলামে নিষিদ্ধ। হযরত আবূ হরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন – একদা রাসূল (স.) বাজারে এক খাদ্য স্তুপের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্য স্তুপের ভিতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভিতরেরগুলো ভিজা। তিনি খাদ্য বিক্রেতার নিকট জানতে চাইলেন – এটি কেমন কথা? সে বলল – বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, হে আল্লাহর রাসূল! তদুত্তরে রাসূল (স.) বললেন – তাহলে তুমি খাদ্যগুলো উপরে রাখনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত। অতঃপর নবি (স.) বললেন – যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে সে আমার উম্মাত নয়। (সাহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১০২)।
- সরকারের প্রতি পরামর্শ :
১. প্রশাসনিক কঠোরতা বৃদ্ধি করুন এবং কর্তব্যে উদাসীন ও ঘুষখোর অফিসারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। তাদেরকে গ্রামে ও বাজারে পাঠিয়ে ভেজালের অপকারিতা সম্পর্কে চাষী ও ব্যবসায়ীদের সজাগ করে তুলতে বলুন।
২. দলীয় নিয়োগ নীতি বাতিল করে মেধা, সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসনের সর্বত্র লোক নিয়োগ করুন। সেই সাথে চাঁদাবাজ ও দলীয় ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করুন। - ৩. ফরমালিন ও বিষাক্ত কেমিক্যাল তৈরীর কারখানাগুলির বিপণন কঠোরভাবে তদারকি করুন। সাথে সাথে যাতে এগুলি বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, তার যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিন।
- ৪. দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের এমন কিছু আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ করুন, যা বিষমুক্ত ভাবে শস্য ও ফল-মূল সংরক্ষণে সহায়ক হয়। সাথে সাথে ভেজাল শনাক্ত করণ মেশিন ও যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করুন ও এর উপরে ছাত্র ও যুবকদের প্রশিক্ষণ দিন।
- ৫. চাষী ও ব্যবসায়ীদেরকে আল্লাহর উপরে ঈমান বৃদ্ধি ও তাক্বদীরে বিশ্বাসী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করুন এবং তাদেরকে হালাল রূযী গ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করুন।
- ৬. প্রত্যেক গ্রামের সৎ কৃষক ও বাজারের সৎ ব্যবসায়ীদের পুরস্কৃত করুন ও তাদের তালিকা টাঙিয়ে দিন।
- ৭. ভেজাল শনাক্তকারী মেশিনে পরীক্ষা করে বাজারে মালামাল সরবরাহ নিশ্চিত করুন। এজন্য বাজার কেন্দ্রিক নির্দলীয় ‘ভোক্তা কমিটি’ গঠন করে তাদের সহযোগিতা নিন।
- ৮. ভ্রাম্যমান আদালতের সংখ্যা ও তাদের লোকবল বৃদ্ধি করুন।
- ৯. ঔষধ প্রশাসনকে গতিশীল করুন। দেশে বর্তমানের মাত্র ২টির স্থলে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরীর সংখ্যা প্রতি উপযেলায় একটি করে স্থাপন করুন। সেই সাথে সারা দেশে বর্তমানের মাত্র ৩৩ জনের স্থলে প্রতি উপযেলায় অন্ততঃ একজন করে ড্রাগ সুপার ও সহকারী সুপার নিয়োগ দিন।
- ১০. সরকারী কর্মকর্তাদের সরাসরি কৃষক ও উৎপাদকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে বলুন। সেই সাথে গ্রামের কৃষক, ব্যবসায়ী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিকটে গিয়ে তাদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করতে বলুন।
পরিশেষে বলব, অন্য সবকিছুর চাইতে খাদ্যে ও ঔষধে ভেজাল দেওয়া সবচাইতে মারাত্মক অপরাধ। কেননা খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচে না। আর ঔষধ ছাড়া রোগ সারে না। যেকোন মানুষ এ দু’টি বস্ত্ত ছাড়া দুনিয়ায় বাঁচতে পারে না। যারা এসবে বিষ দেয় ও ভেজাল মেশায়, তারাও এসবের মুখাপেক্ষী। দেখা যাবে যে, তারই বিষ দেওয়া ফল খেয়ে সে নিজে বা তার কোন নিকটাত্মীয় রোগাক্রান্ত হয়েছে বা মৃত্যু বরণ করেছে। তারই তৈরী ভেজাল ঔষধে তার নিজের বা তার কোন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। তার ভাবা উচিত যে, দুনিয়ায় মানুষকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। ‘মানুষের চোখের চাহনি ও অন্তরের গোপন কথা তিনি জানেন’ (মুমিন ৪০/১৯)। অতএব যারা এগুলি করেন এবং যারা এগুলিতে প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন, সকলে সমানভাবে দায়ী হবেন এবং সবাইকে ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহর সম্মুখে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি দুনিয়াতে বসবাস কর এমন অবস্থায় যেন তুমি একজন আগন্তুক ব্যক্তি অথবা পথযাত্রী মুসাফির। আর তুমি সর্বদা নিজেকে কবরের বাসিন্দাদের মধ্যে গণ্য কর’।